পুরাতন টায়ারের ব্যবসা করার নিয়ম ও সম্পূর্ণ পদ্ধতি
পুরনো বাস, ট্রাক, টমটম, মাইক্রোবাস, লরি এর পুরনো টায়ার গুলো সংগ্রহ করে একটি লাভজনক ব্যবসা দাঁড় করাতে পারেন। এই লেখাটিতে আমরা আলোচনা করব পুরাতন টায়ারের ব্যবসা সম্পর্কে। কিভাবে এই ব্যবসা শুরু করবেন, কত টাকা ইনভেস্ট করতে হবে এবং কত টাকা প্রফিট মার্জিন থাকবে।
আমরা অনেকেই একটি ইউনিক লাভজনক ব্যবসা আইডিয়া খুঁজে থাকি। পুরাতন টায়ারের ব্যবসা বর্তমানের ইউনিক ও লাভজনক আইডিয়া গুলোর মধ্যে অন্যতম। কেননা বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়ায় খুবই কম পুরনো টায়ারের ব্যবসা করা হয়।
তাই বলা যায় আমাদের জন্য এটি একটি সম্ভাবনাময় ব্যবসার সেক্টর। আপনি যদি সম্পূর্ণ পদ্ধতি মেনে এই ব্যবসাটি পরিচালনা করেন তাহলে এই ব্যবসায় লস হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে পুরনো টায়ারের বিজনেস করার জন্য আপনাকে অনেক পরিশ্রমী হতে হবে।
পুরাতন টায়ারের ব্যবসা
ফেলে দেওয়া পুরনো টায়ারের রিসাইক্লিন ব্যবসাকে এক কথায় স্ক্রাফ্ট টায়ার বিজনেস বা টায়ার রিসাইকেলিং ব্যবসা (Business) বলে। এই ব্যবসার শুরুতেই আপনারা ২০,০০০ থেকে ৪০,০০০ টাকা ইনকাম করতে পারবেন।
এবং সম্পূর্ণভাবে ব্যবসা দাঁড় করানোর পরে প্রতি মাসে লক্ষাধিকের বেশি টাকা ইনকাম করতে পারেন। পরিতক্ত টায়ার গুলোকে রিসাইকেলিং প্লান্টে রিসাইকেলিং করে মূলত প্রধান তিনটি প্রোডাক্ট তৈরি করা হয়।
- ফুয়েল অয়েল বা জ্বালানি তেল।
- স্টিল ওয়ার বা স্টিলের তার।
- কার্বন।
ফুয়েল অয়েল মূলত কল কারখানার জ্বালানি তেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এবং স্টিল ওয়ার গলিয়ে নুতন নুতন প্রোডাক্ট তৈরি করা হয়। কার্বন দিয়ে মূলত জুতোর সোল, রাবার, প্লাস্টিক জাতীয় হাজারো প্রোডাক্ট তৈরি করা হয়।
কিভাবে রিসাইকেলিং টায়ারের ব্যবসা শুরু করবেন
ফেলে দেওয়া পুরানো টায়ারের রিসাইকেলিং ব্যবসা আপনি ২ ধরনের করতে পারবেন। আপনার যে পরিমানে টাকা ইনভেস্ট করার ক্যাপাসিটি আছে ওই অনুযায়ী রিসাইকেলিং টায়ারের ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। ব্যবসার ধরন ২টি হলঃ
- স্ক্রাফট টায়ার বিক্রির ব্যবসা।
- স্ক্রাফট ট্রায়ার রিসাইকেলিং ইউনিট।
স্ক্রাফট টায়ার বিক্রির ব্যবসা
আপনি যদি অল্প টাকার মধ্যে একটি পুরনো টায়ারের ব্যবসা শুরু করতে চান তাহলে, স্ক্রাফট টায়ার বিক্রির ব্যবসা শুরু করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার কাজ হল, আপনি বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরনো টায়ার সংগ্রহ করে নিয়ে এসে আপনার একটি গোডাউন বা কল কারখানায় জমা করবে।
এরপরে টায়ার টিকে ছোট ছোট টুকরো করে, বিভিন্ন পার্টস আলাদা করে নিয়ে মালগুলো রেডি রাখবেন। যখন অনেক মাল সংগ্রহ করা হবে (কুইন্টাল বা টন হিসেবে) তারপরে সরাসরি সেলারের কাছে বিক্রি করে দিবেন। এই মালগুলো মূলত রিসাইকেলিং ইউনিট এর কাছে বিক্রি করতে পারবেন।
রিসাইকেলিং ইউনিট কিভাবে খুজে পাবেন এই সম্পর্কে লেখাটির নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ব্যবসা শুরুর পূর্বে অবশ্যই এই লেখাটির সম্পূর্ণ পড়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।
স্ক্রাফট ট্রায়ার রিসাইকেলিং ইউনিট
এরপরে এই ব্যবসায় ইনভেস্ট করার জন্য যদি আপনার কাছে বেশি মূলধন থাকে তাহলে আপনি নিজেই একটি স্ক্রাফট ট্রায়ার রিসাইকেলিং ইউনিট তৈরি করতে পারেন। এটি একটি কোটি টাকার ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হবে, কেননা এখানে ইনভেস্টের পরিমাণ অনেক বেশি প্রয়োজন হবে।
এখানে আপনার কাজ হল, যারা স্ক্রাফট টায়ার বিক্রি করে তাদের কাছ থেকে ঐ টুকরো টুকরো টায়ার কুইন্টাল বা টন হিসেবে ক্রয় করে আপনার রিসাইকেলিং ইউনিটে বিভিন্ন মেশিন কাজে লাগিয়ে এখান থেকে ৩টি আইটেম বের করবেন।
ব্যবসা আইডিয়াঃ ছোট ফ্যাক্টরি আইডিয়া।
আইটেমগুলো হল ফুয়েল অয়েল, স্টিল ওয়ার ও কার্বন। এরপরে এই আইটেম গুলো বা উপাদান গুলো তাদের বিশেষ কারখানায় পৌঁছে দিবেন। তথা ফুয়েল ওয়েল আপনি পার্টিকুলার কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারবেন এবং স্টিল ওয়ার আপনি স্টিলের কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারবেন।
কার্বন প্লাস্টিক বা রাবারের কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারবেন। এই সম্পূর্ণ প্রসেসটি হল স্ক্রাফট টায়ার রিসাইকেলিং ইউনিট এর কাজ। এই কাজ করার জন্য আপনাকে প্রথমদিকে অনেক টাকা ইনভেস্ট করতে হবে, কেননা অনেক মেশিনারি ক্রয় করতে হবে।
কত টাকা ইনভেস্টমেন্ট প্রয়োজন
১. আপনি যদি শুধুমাত্র পুরনো টায়ার সংগ্রহ করে ছোট ছোট টুকরো করে রিসাইকেলিং ইউনিটের কাছে বিক্রি করতে চান তাহলে, সেক্ষেত্রে আপনি ১০,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা ইনভেস্ট করে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।
প্রথমে আপনি আপনার বাড়ির কাছাকাছি একটি কারখানা বা গোডাউন তৈরি করবেন। মোটামুটি ভাবে ২০০ স্কয়ার ফিট থেকে ৩০০ স্কয়ার ফিট একটি জায়গা নিলে কারখানা বা গোডাউন তৈরি করতে পারবেন। টায়ার কাটা ও ছোট ছোট স্ক্রাফট তৈরির জন্য অনেকটা জায়গার প্রয়োজন হয়।
এরপরে যেখানে গাড়ির টায়ার পরিবর্তন করা হয় সেখান থেকে অল্প দামে পুরনো টায়ার গুলো ক্রয় করে এনে ছোট ছোট বিভিন্ন কাটার যন্ত্র দিয়ে, এগুলো কাটাকাটি করে ছোট ছোট স্ক্রাফট তৈরি করবেন। টায়ার কাটার যন্ত্র গুলো বানানোর জন্য কামারদের সাথে যোগাযোগ করুন।
ব্যবসা আইডিয়াঃ স্টক ব্যবসার আইডিয়া।
এরপরে যখন অনেক টায়ার কাটা বা স্ক্রাফট জমা হবে তখন মন হিসেবে ট্রাক লোড দিয়ে রিসাইকেলিং ইউনিট প্লান্ট এর কাছে বিক্রয় করতে পারবেন। আপনার ইনভেস্টের টাকাগুলো মূলত পুরনো টায়ার কিনতে ও বিভিন্ন টুলস তৈরি করতে খরচ হবে।
২. আপনি যদি রিসাইকেলিং ইউনিট ব্যবসা শুরু করতে চান তাহলে প্রাথমিক ইনভেস্ট হিসেবে প্রায় ১৫ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ টাকা ইনভেস্ট করতে হবে। কেননা রিসাইকেলিং ইউনিট এর ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রথমে স্ক্রাফট টায়ার বিক্রেতাদের কাছ থেকে স্ক্রাফট টায়ার এর ছোট টুকরোগুলো মন হিসেবে ক্রয় করে আনতে হবে।
আপনি যদি এই ব্যবসা শুরু করতে চান তাহলে প্রথমে ৫/৬ ধরনের মেশিন ক্রয় করতে হবে। প্রত্যেকটি মেশিনের দাম আনুমানিক ১-২ লক্ষ টাকা। মেশিনগুলো হলঃ
- ওয়্যার সিপারেটিং
- স্ট্রাফট কাটিং
- হলার
- স্ক্রাফট মেকিং
- গ্রেনেউন্চ
ইত্যাদি, মেশিন প্রয়োজন হবে। এবং এই ব্যবসার জন্য আপনাকে কমপক্ষে ১০০০ স্কয়ার ফুট একটি কারখানা বা গোডাউন প্রয়োজন হবে।
তবে আমার পরামর্শ থাকবে, প্রথমে রিসাইকেলিং প্লান্ট ইউনিটের ব্যবসা শুরু না করে অল্পটাকা ইনভেস্ট করে স্ক্রাফট টায়ার তৈরির ব্যবসা শুরু করা ভালো। পরবর্তীতে যখন আপনি এই মার্কেট সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা অর্জন করবেন এবং সেলারদের ডিমান্ড বুঝবেন তখন আপনি নিজে ইনভেস্ট করার মত টাকা জমিয়ে নিতে পারবেন ও এই ব্যবসায় আপনার অভিজ্ঞতা থাকবে।
তখন আপনি খুব সহজেই একটি রিসাইকেলিং ইউনিট এর ব্যবসা শুরু করতে পারেন। প্রথমদিকে অল্প টাকায় ব্যবসা শুরু করলে আস্তে আস্তে এই ব্যবসা সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা পরিপূর্ণ হবে।
কি কি মেশিনারি বা জিনিসপত্র প্রয়োজন হবে
১. প্রথমে স্ক্রাফট টায়ার বিক্রির ব্যবসা শুরু করার জন্য কয়েকটি টায়ার কাটার টুলস প্রয়োজন হবে। কাটিং ব্লেড, কাটিং ওয়্যার, কাটিং সিজার ইত্যাদি প্রয়োজন হবে। নিকটস্থ কোনো কামারশালা থেকে এই ধরনের টুলস গুলো তৈরি করে নিতে পারবেন।
২. টায়ার রিসাইকেলিং ইউনিট এর ব্যবসা শুরু করার জন্য আপনাকে কমপক্ষে ৫/৬টি মেশিন ক্রয় করার প্রয়োজন হবে। যেমন: ওয়্যার সিপারেটিং, হলার, গ্রেনেউন্চ, স্ট্রাফট কাটিং, স্ক্রাফট মেকিং ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু সাধারণ টুলস প্রয়োজন হতে পারে। এই মেশিনগুলো দেশের বাহির থেকে ইমপোর্ট করার প্রয়োজন হতে পারে।
পুরাতন টায়ারগুলো কোথায় বিক্রি করবেন
১. এই পুরনো টায়ার গুলো আপনারা অনলাইনে কিংবা অফলাইনে বিক্রি করতে পারবেন। আপনি যদি ইন্ডিয়ায় বসবাস করেন তাহলে ইন্ডিয়ার সব থেকে বড় হোলসেল মার্কেট (ইন্ডিয়া মার্ট) এ একটি সেলার অ্যাকাউন্ট খুলে স্ক্রাফট টায়ার গুলো বিক্রি করতে পারবেন।
বাংলাদেশ থেকে অনলাইনে বিক্রির জন্য বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ আছে তাদের সাথে যোগাযোগ করে পুরাতন টায়ার গুলো বিক্রি করতে পারেন। এছাড়াও অফলাইনে বিভিন্ন ধরনের রিসাইকেলিং ইউনিটের সাথে কথা বলে তাদের কাছে এগুলো টন হিসেবে বিক্রয় করতে পারেন।
২. টায়ার রিসাইকেলিং ইউনিটের ব্যবসা শুরু করলে, এই টায়ারের স্ক্রাফট গুলো থেকে যে ধরনের মেটেরিয়াল তৈরি হবে সেগুলো বিভিন্ন কোম্পানিতে বিক্রয় করতে পারবেন।
- ফুয়েল ওয়েল আপনি পার্টিকুলার কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারবেন।
- স্টিল ওয়ার আপনি স্টিলের কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারবেন।
- কার্বন প্লাস্টিক বা রাবারের কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে পারবেন।
এছাড়াও আপনাদের সুবিধার্থে কয়েকটি কোম্পানির ডিটেলস দেওয়া হল, যাদের সাথে যোগাযোগ করে স্ক্রাফট টায়ার ম্যাটেরিয়ালস বিক্রি করতে পারবেন।
- Tinna Rubber And Infrastructure Ltd Haldia (33F6+V4R, NH 41, Dighasipur, Haldia, West Bengal 721645)
- Peter’s Tyre Recycling Factory (76CX+X4P, Puthenchira, Kerala 680682)
প্রফিট মার্জিন কেমন হবে
পুরাতন টায়ারের ব্যবসা থেকে আপনি কত টাকা প্রফিট করতে পারবেন এটা সম্পূর্ণ সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে কিছুটা ধারণা দেয়া যেতে পারে। সাধারণত পুরনো স্ক্রাফট টায়ার গুলো প্রতি কেজি ১২ থেকে ১৪ টাকা রেটে বিক্রি করতে পারবেন।
ব্যবসা আইডিয়াঃ লাভজনক কয়েকটি ৫০ হাজার টাকায় ব্যবসা আইডিয়া।
মোটামুটি ভাবে যদি আপনি ১ টন স্ক্রাফট টায়ার বিক্রি করেন তার জন্য সর্বোচ্চ খরচ পূর্বে ২,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা। এরপরে ১ টন মাল যদি আপনি ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকায় বিক্রি করেন তাহলে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আপনার প্রফিট থাকবে প্রতিটন মালে।
এভাবে করে যদি আপনি প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫ টন মালামাল বিক্রয় করতে পারেন, তাহলে প্রতি মাসে একটি হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্ট এর টাকা আপনার লাভ থাকবে। এরপরে যখন আপনার ডিমান্ড বাড়বে এবং মার্কেটে আপনার ভ্যালু বাড়বে তখন আপনার মাসিক ইনকাম সেই অনুযায়ী বৃদ্ধি পাবে।
এবং স্ক্রাফট টায়ার রিসাইকেলিং করে যে ম্যাটেরিয়াল গুলো তৈরি হবে সেগুলো বিভিন্ন কোম্পানির কাছে চুক্তি করে বিক্রয় করতে পারবেন। তবে প্রথম দিকে আপনার প্রফিট মার্জিন একটু কম হবে, পরবর্তীতে এই মার্কেট সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা অর্জন করলে প্রফিট মার্জিন বৃদ্ধি করতে পারবেন।
এই ব্যবসা সম্পর্কে আমাদের শেষকথা
পুরাতন টায়ারের ব্যবসা একটি অভিনব ইউনিক ও লাভজনক ব্যবসা আইডিয়া। এই ব্যবসায় প্রফিট মার্জিন অনেক ভালো যা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। পুরাতন ফেলে দেওয়া টায়ার গুলো সংগ্রহ করে এভাবে আপনি একটি লাভজনক ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
তবে যে কোন ব্যবসা শুরু করার পূর্বে আপনাকে উক্ত ব্যবসার সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করতে হবে। এবং আমার দেওয়া এই তথ্যগুলো আপনাকে নিজেকে যাচাই করে নিতে হবে। শুভকামনা রইল আপনার ব্যবসায়িক জীবনের জন্য।
FAQs
আপনার আশেপাশের রিসাইকেলিং ইউনিট কোথায় আছে তা জানার জন্য প্রথমে গুগলে গিয়ে সার্চ করুন “recycling plant near me” অথবা “near me recycling plant location” লিখে। এরপরে গুগল-মামা আপনাকে আশেপাশের রিসাইকেলিং ইউনিট লোকেশন দেখিয়ে দিবে।
পুরাতন টায়ার সংগ্রহ করার জন্য আপনার নিকটস্থ গাড়ির গ্যারেজ গুলোতে যোগাযোগ করুন, যে সকল গ্যারেজে গাড়ির টায়ার পরিবর্তন করা হয়। এছাড়াও শহরে অনেক দোকান আছে যারা পুরনো টায়ার বিক্রয় করে তাদের থেকে এগুলো সংগ্রহ করতে পারেন।