Others

রোজা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা: সত্য এবং মিথ্যা

রোজা ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এটি মুসলিমদের জন্য আত্মশুদ্ধি, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম। তবে রোজা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা রয়েছে যা মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এই নিবন্ধে আমরা রোজা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করব এবং সঠিক তথ্য প্রদান করব যাতে মুসলমানরা রোজা পালন করতে পারে নির্ভুলভাবে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে।

বিষয়বস্তুর সহজ সারণী

ভুল ধারণা ১: টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজার ফলে রোজা ভেঙে যায়

রোজা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা
Image credit – somoynews

 

অনেকেই বিশ্বাস করেন যে রোজা রেখে টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজলে রোজা ভেঙে যায়। এই ধারণাটি সঠিক নয়। ইসলামিক শিক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, দাঁত মাজা রোজা ভঙ্গের কারণ নয়। তবে দাঁত মাজার সময় টুথপেস্ট বা মাজনের কোনো অংশ গিলে ফেললে রোজা ভঙ্গ হতে পারে। তাই এই সময় মেসওয়াক ব্যবহার করাই উত্তম। মেসওয়াক ব্যবহারে দাঁতের সুরক্ষা যেমন হয়, তেমনি এটি একটি সুন্নতও।

অতএব, রোজা রেখে দাঁত মাজার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। যদি টুথপেস্ট ব্যবহার করতেই হয়, তবে সাবধানতার সাথে করতে হবে যাতে কোনো অংশ গিলে না ফেলা হয়। এটি রোজা ভঙ্গের কারণ হতে পারে না ঠিকই, তবে মাকরুহ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রমজান মাসে মেসওয়াকের অভ্যাস গড়ে তোলা একটি ভালো এবং ইসলামের সঠিক রীতি পালন।

ভুল ধারণা ২: স্বামী-স্ত্রীর চুমু বা আলিঙ্গন রোজা ভঙ্গ করে

 

ভুল ধারণা ২
Image credit – Quora

অনেকেই মনে করেন যে রোজা রেখে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চুমু খাওয়া বা আলিঙ্গন করা রোজা ভঙ্গ করে। এই ধারণাটি সঠিক নয়। হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) রোজা রেখে তাঁর স্ত্রীকে চুমু খেতেন এবং আলিঙ্গন করতেন। তবে এটি মাকরুহ হতে পারে যদি গোসল ফরজ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।

এক্ষেত্রে যুবকদের সতর্ক থাকা উচিত যাতে রোজা নষ্ট না হয়। রোজা একটি আত্মসংযমের মাস, তাই এই মাসে দিনে যৌন উত্তেজক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা উচিত। এছাড়াও, যদি চুমু বা আলিঙ্গন করতে গিয়ে অজান্তে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যা গোসল ফরজ হওয়ার কারণ হতে পারে, তবে তা মাকরুহ বলে গণ্য হবে। রোজার পবিত্রতা বজায় রাখতে এবং আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য রোজা অবস্থায় এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।

ভুল ধারণা ৩: শুধুমাত্র খাবার বা পানি পান করলেই রোজা ভেঙে যায়

ভুল ধারণা ৩
Image credit – jagonews24

 

অনেকেই মনে করেন যে রোজা রাখার সময় শুধুমাত্র খাবার বা পানি পান করলেই রোজা ভেঙে যায়। কিন্তু ইসলামী বিধানে উল্লেখ আছে যে কিছু অন্যান্য কার্যকলাপও রোজা ভঙ্গের কারণ হতে পারে। যেমন, মিথ্যা বলা, গুজব ছড়ানো, গালিগালাজ করা, এবং অন্যান্য পাপ কার্যকলাপ রোজার গুরুত্ব এবং পবিত্রতা নষ্ট করে দেয়।

ইসলামের মূল শিক্ষা হল আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধি। সুতরাং, রোজার সময় শুধু খাবার এবং পানীয় থেকে বিরত থাকা নয়, বরং সব ধরণের খারাপ আচরণ থেকেও বিরত থাকতে হবে। একজন রোজাদারকে সবসময়ই নিজের কথা এবং কাজের দিকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনো ভুল না হয় যা তার রোজার পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে।

এছাড়া, রোজা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা হল যে রোজা রাখার সময় ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার কষ্টই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, রোজার মূল উদ্দেশ্য হল আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই, রোজার সময় মন এবং দেহকে খারাপ কাজ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা উচিত।

ভুল ধারণা ৪: ভুলবশত খেয়ে ফেললে রোজা ভেঙে যায়

 

ভুল ধারণা ৪
Image credit – dhakapost

অনেকের মধ্যে এই ভুল ধারণা রয়েছে যে ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেললে রোজা ভেঙে যায়। কিন্তু ইসলামিক বিধান অনুযায়ী, ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেললে বা পান করলে রোজা ভঙ্গ হয় না। এই পরিস্থিতিতে, রোজাদারকে শুধু রোজা পালন চালিয়ে যেতে হবে এবং ভুলবশত খাওয়া বা পান করার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আল্লাহ তাআলা বান্দার ভুল এবং অসাবধানতাজনিত কাজকে ক্ষমা করে থাকেন। তাই রোজাদার যদি ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলে, তবে তার রোজা ভেঙে যায় না এবং তাকে নতুন করে রোজা রাখার প্রয়োজন হয় না। তবে রোজাদারের সতর্ক থাকা উচিত এবং রোজা পালনকালে ভুলবশত এমন কিছু না করার চেষ্টা করা উচিত যা তার রোজার পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে। রোজার সময় ভুলবশত খেয়ে ফেলার ক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে রোজা চালিয়ে যাওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়াই সবচেয়ে ভালো উপায়। ইসলামের মূল শিক্ষা হল আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধি, তাই রোজা পালনকালে সবসময় নিজের কাজের দিকে খেয়াল রাখা উচিত।

এই ধরনের ভুল ধারণা দূর করার জন্য রোজা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা গুরুত্বপূর্ণ।

ভুল ধারণা ৫: ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার করা

ভুল ধারণা ৫
Image credit – oneindia bengali

 

অনেকেই মনে করেন রোজা রেখে ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যায়। এই ধারণাটি সঠিক নয়। ইসলামী বিধান অনুযায়ী, ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার করা রোজা ভঙ্গের কারণ হয় না যদি তা পুষ্টি যোগানোর উদ্দেশ্যে না হয়। উদাহরণস্বরূপ, রোগীর চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ইনজেকশন বা ওষুধ রোজা ভঙ্গ করে না, কিন্তু গ্লুকোজ বা অন্য কোন পুষ্টি দ্রব্যের ইনজেকশন রোজা ভঙ্গের কারণ হতে পারে।

তাছাড়া, চোখ বা কান বা নাকের ড্রপ ব্যবহার করা, বা কোনো পেইনকিলার বা অন্যান্য জরুরি ওষুধ সেবন করা রোজা ভঙ্গের কারণ নয়। তবে, রোজাদারের উচিত রোজা ভঙ্গের আশঙ্কা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ বা চিকিৎসা গ্রহণ করা। ইসলামের মূল শিক্ষায় রয়েছে যে, স্বাস্থ্য এবং জীবন রক্ষা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাই রোজার সময় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি রয়েছে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

 

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
Image credit – Quora

প্রশ্ন ১: বমি করলে কি রোজা ভেঙে যাবে?

ইসলামিক বিধান অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোজা ভেঙে যাবে। কিন্তু যদি ভুলবশত বা অসুস্থতার কারণে বমি হয়, তাহলে রোজা ভাঙবে না। এ ক্ষেত্রে রোজাদারকে শুধু মুখ পরিষ্কার করে রোজা পালন চালিয়ে যেতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করার ক্ষেত্রে, রোজাদারকে পরবর্তী সময়ে কাজা রোজা পালন করতে হবে।

প্রশ্ন ২: রোজা রেখে সাঁতার কাটতে বা স্নান করতে পারবো?

রোজা রেখে সাঁতার কাটা বা স্নান করা ইসলামিক বিধানে অনুমোদিত। তবে, এ ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে যাতে সাঁতার কাটার সময় বা স্নান করার সময় কোনো পানি গিলে ফেলা না হয়। পানির কোনো অংশ মুখ বা নাক দিয়ে গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যেতে পারে। তাই রোজার পবিত্রতা রক্ষা করতে সাবধানে সাঁতার কাটা বা স্নান করা উচিত। রোজা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা দূর করতে এবং সঠিকভাবে রোজা পালন করতে এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন।

প্রশ্ন ৩: রোজা রেখে ধূমপান করা যাবে?

রোজা রাখার সময় ধূমপান করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ধূমপান রোজা ভঙ্গের কারণ হয়। রোজা শুধুমাত্র খাবার এবং পানীয় থেকে বিরত থাকার জন্য নয়, বরং এটি একটি আত্মসংযমের মাস যেখানে সব ধরণের ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে বিরত থাকা উচিত। রোজার সময় ধূমপান করা থেকে বিরত থাকা উচিত এবং রোজার পবিত্রতা বজায় রাখা উচিত।

প্রশ্ন ৪: রোজার সময় কি রক্ত দেওয়া যাবে?

রোজার সময় রক্ত দেওয়া ইসলামিক বিধানে অনুমোদিত। রক্তদান রোজা ভঙ্গ করে না, তবে যদি রক্তদানে শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং রোজা পালন করতে কষ্ট হয়, তাহলে তা এড়ানো উচিত। রোজাদারের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা রক্ষার জন্য রোজার সময় রক্তদান করা যেতে পারে তবে সাবধানে করতে হবে।

প্রশ্ন ৫: মেকআপ বা পারফিউম ব্যবহার করা কি রোজা ভঙ্গ করে?

রোজার সময় মেকআপ বা পারফিউম ব্যবহার করা রোজা ভঙ্গের কারণ হয় না। তবে, মুখের ভিতরে কিছু না যাওয়া এবং সুগন্ধি বা অন্য কোন বস্তু না গিলে ফেলা নিশ্চিত করতে হবে। রোজার সময় দেহের বাহ্যিক যত্ন নেওয়া যেতে পারে কিন্তু মুখের ভিতরে কিছু প্রবেশ করানো যাবে না।

প্রশ্ন ৬: রোজার সময় কি গসলে রোজা ভেঙে যাবে?

রোজার সময় গোসল করা অনুমোদিত এবং তা রোজা ভঙ্গ করে না। ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে, গোসলের সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনো পানি মুখ বা নাক দিয়ে গিলে ফেলা না হয়। এভাবে সতর্কভাবে গোসল করলে রোজা নষ্ট হবে না।

উপসংহার

রোজা নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। রোজা হল আত্মসংযম এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মাধ্যম। সঠিক জ্ঞান এবং ইসলামী বিধানের আলোকে রোজা পালন করলে এই ইবাদতটি সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব। সন্দেহ দূর করতে এবং সঠিক তথ্য পেতে সর্বদা প্রামাণিক উৎস থেকে জ্ঞান অর্জন করুন। রোজার পবিত্রতা বজায় রেখে আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য সঠিকভাবে রোজা পালন করুন।

Related Articles

Back to top button