চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত: সঠিক কাঠামো ও নমুনাসহ গাইড

আপনি যখন কোনও চাকরি থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন সেটি কেবল একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়—এটি একটি পেশাদার প্রক্রিয়াও। এই প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত বা রিজাইনেশন লেটার প্রদান করা। এই দরখাস্তের মাধ্যমে আপনি প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন যে, নির্দিষ্ট তারিখ থেকে আপনি আর দায়িত্ব পালন করবেন না।
এই চিঠিটি একটি নথিভুক্ত দলিল হিসেবেও কাজ করে, যা ভবিষ্যতে রেফারেন্স বা প্রয়োজনীয় প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। অনেক সময় আপনি যদি মৌখিকভাবে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান, সেটি কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে গ্রহণ নাও করতে পারে। অথচ একটি সঠিকভাবে লেখা দরখাস্ত কর্তৃপক্ষকে সময় দেয় নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়ার বা দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত হওয়ার।
এছাড়াও, এমন একটি দরখাস্ত পেশাদারিত্বের ছাপ রেখে যায়। এটি আপনার চাকরির মেয়াদজুড়ে প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্মান, দায়িত্ব ও কৃতজ্ঞতাবোধকে তুলে ধরে। আপনি হয়তো ভালো সুযোগ পেয়ে চাকরি ছাড়ছেন, অথবা ব্যক্তিগত কোনো কারণে। কারণ যাই হোক, একটি সুগঠিত ও বিনীত দরখাস্ত কখনোই অবহেলার চোখে দেখা হয় না—বরং তা ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে।
চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত কী?
চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত একটি লিখিত নথি যার মাধ্যমে আপনি স্বেচ্ছায় আপনার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। এটি মূলত একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কর্মচারী ও নিয়োগকর্তার মধ্যে চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক শেষ হয়। আপনি যখন চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন শুধু মৌখিকভাবে জানিয়ে দিলেই হয় না—লিখিতভাবে এবং সঠিক ফরম্যাটে জানানো একটি পেশাগত দায়িত্ব।
এই দরখাস্ত সাধারণত সংক্ষিপ্ত, বিনীত এবং তথ্যভিত্তিক হয়। আপনি এতে উল্লেখ করেন আপনার অব্যাহতির কারণ, শেষ কর্মদিবস, এবং অনেক সময় কৃতজ্ঞতাসূচক বক্তব্যও যোগ করেন। এটি নিয়োগকর্তার জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে আপনি দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং প্রতিষ্ঠানের প্রটোকল মানছেন।
চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত একটি প্রাতিষ্ঠানিক রেকর্ড হিসেবেও সংরক্ষিত থাকে। ভবিষ্যতে যদি আপনি সেই প্রতিষ্ঠানে ফেরত আসতে চান বা তাদের থেকে রেফারেন্স প্রয়োজন হয়, তখন এই দরখাস্তে থাকা আপনার পেশাগত আচরণ তাদের চোখে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এটি রিজাইনেশন লেটার-এরই সমার্থক শব্দ, তবে অনেক সময় সরকারি বা বাংলা প্রেক্ষাপটে “দরখাস্ত” শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। আবার, রিজাইন লেটার সাধারণত ইংরেজি ভাষায় হয়, আর দরখাস্ত বাংলায় লেখা হয়। দুই ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য একই—সুশৃঙ্খলভাবে কর্মপর্বের সমাপ্তি ঘটানো।
উদ্দেশ্য ও সুবিধা
একটি সঠিকভাবে রচিত চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত শুধুমাত্র একটি ফর্মালিটি নয়, বরং এটি আপনার ক্যারিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে গুছিয়ে শেষ করার স্মারক হিসেবেও কাজ করে। আপনি হয়তো নতুন কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন বা ব্যক্তিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন—তবে সুষ্ঠুভাবে চাকরি ছাড়ার প্রক্রিয়াটিও হওয়া উচিত পরিপূর্ণ ও পেশাদার।
প্রথমত, দরখাস্তের মাধ্যমে আপনি অফিসিয়ালি জানিয়ে দেন যে আপনি চাকরির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছেন। এতে করে কর্তৃপক্ষ সহজে নতুন কাউকে আপনার স্থলে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা নিতে পারে এবং দায়িত্ব হস্তান্তরও সুশৃঙ্খলভাবে হয়। দ্বিতীয়ত, এটি প্রতিষ্ঠান ও কর্মচারীর মধ্যে ভবিষ্যতের সম্পর্ক রক্ষায় সহায়তা করে। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানে পুনরায় যোগদানের সুযোগ বা রেফারেন্স পেতে দরখাস্তের ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
তৃতীয়ত, আপনার পেশাগত ইমেজ একটি ভাল দরখাস্তের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হতে পারে। চিঠিতে কৃতজ্ঞতা, সৌজন্য ও স্পষ্ট বার্তা থাকলে তা আপনার প্রতি প্রতিষ্ঠানের শ্রদ্ধাবোধ বাড়ায়। চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত-এর একটি বড় সুবিধা হলো এটি একটি লিখিত রেকর্ড হিসেবে পরবর্তীতে যেকোনো বিতর্ক বা ভুল বোঝাবুঝি প্রতিরোধ করে।
কাঠামো ও বিন্যাস
একটি কার্যকর চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত লেখার জন্য নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করা জরুরি। একটি দরখাস্ত যতটা পরিষ্কার ও সুশৃঙ্খল হবে, সেটি তত সহজে বোঝা যাবে এবং পেশাদারিত্বের ছাপ পড়বে। নিচে প্রতিটি ধাপ বিশ্লেষণ করে দেওয়া হলো, যাতে আপনি সহজেই নিজের দরখাস্ত প্রস্তুত করতে পারেন।
তারিখ ও বরাবর
দরখাস্তের শুরুতেই ডান পাশে তারিখ লিখবেন, যেদিন আপনি আবেদনটি জমা দিচ্ছেন। এরপর নিচে বাম পাশে “বরাবর” অংশে যার কাছে দরখাস্ত দিচ্ছেন তার নাম, পদবি, প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা লিখুন।
উদাহরণ:
বরাবর
ম্যানেজার
এইচআর বিভাগ
বাংলা সফট লিমিটেড
ঢাকা-১২১২
বিষয় (Subject Line)
বিষয়টি সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্ট হওয়া জরুরি। যেমন:
বিষয়: চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত
সম্ভাষণ ও রেজাইন স্টেটমেন্ট
সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ যেমন “মাননীয়,” বা “শ্রদ্ধেয় স্যার/ম্যাডাম,” ব্যবহার করে শুরু করুন। এরপর প্রথম অনুচ্ছেদে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করুন আপনি কোন পদে আছেন এবং কবে থেকে অব্যাহতি চাচ্ছেন।
ছাড়ার কারণ ও শেষ কর্মদিবসের তারিখ
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করুন কেন আপনি চাকরি ছাড়ছেন—ব্যক্তিগত, স্বাস্থ্যগত বা অন্য কোনো কারণ। এরপর স্পষ্ট করে লিখুন আপনার শেষ কর্মদিবস কবে।
কৃতজ্ঞতা ও সহায়তা পূর্ব কমিটমেন্ট
তৃতীয় অনুচ্ছেদে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন এবং উল্লেখ করুন, প্রয়োজন হলে আপনি হস্তান্তর বা নতুন কর্মীর প্রশিক্ষণে সহায়তা করতে প্রস্তুত।
স্বাক্ষর, নাম ও পরিচয়
শেষে “বিনীত,” বা “সশ্রদ্ধ,” লিখে নিচে নিজের নাম, পদবি এবং স্বাক্ষর যোগ করুন।
নমুনা দরখাস্ত
আপনার সুবিধার্থে এখানে দুটি বাস্তবধর্মী চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত এর নমুনা দেওয়া হলো—একটি অফিস কর্মচারীর জন্য এবং অপরটি সরকারি চাকরিজীবীদের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলো দেখে আপনি নিজের প্রেক্ষাপটে দরখাস্তটি কাস্টমাইজ করে নিতে পারবেন।
অফিস স্টাফের নমুনা দরখাস্ত
বরাবর,
মানবসম্পদ বিভাগের ম্যানেজার
গ্রিন ভ্যালি টেক লিমিটেড
ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৯
বিষয়: চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত
মাননীয়,
বিনীত নিবেদন এই যে, আমি জনাব রফিকুল ইসলাম, আপনার প্রতিষ্ঠানে “অফিস সহকারী” পদে গত ২০২০ সাল থেকে কর্মরত আছি। ব্যক্তিগত কারণবশত আমি ১৫ জুলাই ২০২৫ থেকে আমার পদ থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করছি।
আমি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে হস্তান্তর করতে আগ্রহী এবং নতুন নিযুক্ত সহকর্মীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত। আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব যদি আমার আবেদনটি গ্রহণ করা হয়।
আপনার সদয় অনুমতির প্রত্যাশায় রইলাম।
বিনীত,
রফিকুল ইসলাম
অফিস সহকারী
মোবাইল: ০১৭XXXXXXXX
সরকারি চাকরির জন্য উপযোগী দরখাস্ত
বরাবর,
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
নন্দীগ্রাম উপজেলা
বগুড়া
বিষয়: চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত
মাননীয়,
সশ্রদ্ধ নিবেদন এই যে, আমি মোঃ আনিসুর রহমান, সহকারী শিক্ষক (বাংলা), নন্দীগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত আছি। পারিবারিক ও স্বাস্থ্যগত কারণে আমি ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে আমার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করছি।
আমি আমার সব দায়িত্ব যথাযথভাবে হস্তান্তর করব এবং প্রয়োজনে বিদায়ী সময়কালে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। আমার এই দরখাস্তটি মঞ্জুর করলে কৃতজ্ঞ থাকব।
সশ্রদ্ধ,
মোঃ আনিসুর রহমান
সহকারী শিক্ষক (বাংলা)
ইআইআইএন: ১১০৪৩৪
এই দুটি নমুনা অনুসরণ করে আপনি খুব সহজেই নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী একটি প্রফেশনাল চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত প্রস্তুত করতে পারবেন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি (F.A.Q)
কতদিন আগেই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত জমা দেওয়া উচিত?
সাধারণত প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ দিন থেকে ১ মাস আগে আবেদন জমা দিতে হয়। এটি “নোটিশ পিরিয়ড” হিসেবে পরিচিত। আপনি যদি এই সময়সীমা মেনে দরখাস্ত দেন, তবে কর্তৃপক্ষ নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া বা দায়িত্ব হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিতে পারে। জরুরি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে, তবে সেটি অবশ্যই আলোচনা করে জানানো উচিত।
চাকরি ছাড়ার সময় কি মৌখিকভাবে বললেই হবে?
না, শুধুমাত্র মৌখিকভাবে বললে অফিসিয়ালি গ্রহণযোগ্য হবে না। সবসময় লিখিতভাবে একটি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত জমা দিতে হবে। এটি প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতের ভুল বোঝাবুঝি প্রতিরোধ করবে।
দরখাস্তে কি ছাড়ার কারণ জানানো বাধ্যতামূলক?
হ্যাঁ, এটি অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত। কারণটি সংক্ষিপ্তভাবে এবং পেশাদার ভাষায় লেখা জরুরি। যেমন: ব্যক্তিগত সমস্যা, পারিবারিক কারণ, নতুন কর্মসংস্থানে সুযোগ ইত্যাদি।
অব্যাহতির দরখাস্তে কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত?
অবশ্যই। একটি সৌজন্যপূর্ণ ও কৃতজ্ঞতাসূচক বক্তব্য আপনার পেশাগত ইমেজ উন্নত করে। এতে বোঝানো হয় আপনি প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতাকে সম্মান জানাচ্ছেন।
জরুরি অব্যাহতি চাইলে কী করব?
জরুরি কারণে যদি আপনি দ্রুত অব্যাহতি চান, তবে সেই কারণটি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে দরখাস্ত দিন এবং বিভাগীয় প্রধান বা এইচআর-এর সাথে সরাসরি আলোচনা করুন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আপনার আবেদন গ্রহণ করা হতে পারে।
শেষ কথা (Wrapping Up)
একটি সুশৃঙ্খল এবং পেশাদার চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত আপনার কর্মজীবনের একটি সম্মানজনক সমাপ্তি নিশ্চিত করে। আপনি যেভাবে চাকরি শুরু করেছিলেন, ঠিক তেমনি সুন্দরভাবে চাকরি ছেড়ে যাওয়াও একটি দক্ষতা। এই প্রক্রিয়া শুধু নিয়োগকর্তার চোখে আপনার গুরুত্ব বাড়ায় না, বরং ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
চিঠিটি যত সংক্ষিপ্ত, বিনীত ও স্পষ্ট হবে—ততটাই তা গ্রহণযোগ্য ও পেশাগত মনে হবে। আপনি যেকোনো কারণেই চাকরি ছাড়ুন না কেন, প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং দায়িত্ব যথাযথভাবে হস্তান্তরের মানসিকতা থাকা উচিত।
এছাড়া, সময়মতো দরখাস্ত জমা দিলে নিয়োগকর্তা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি ভালো রেফারেন্স বা সুপারিশ পাওয়ার পথ সুগম করে। তাই চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম কাজ হওয়া উচিত একটি পরিষ্কার ও পেশাগত দরখাস্ত প্রস্তুত করা।
স্মরণে রাখবেন—একটি ভালোভাবে লেখা চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দরখাস্ত কেবল একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি নয়, এটি ভবিষ্যতের সফল ক্যারিয়ারের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তিও হতে পারে।